প্রচ্ছদ








আফজল আলি



একটি মতবাদ বা দর্শনকে কেন্দ্র করে যে পত্রিকা গড়ে ওঠে তার একটা আলাদা গুরুত্ব থেকেই যায়  । আমার নিজের পত্রিকা করার ইচ্ছে কোনোদিনই ছিল না কারণ এত ম্যাগাজিনের মাঝে আর একটির জন্মগ্রহণ মানে নিছক গতানুগতিক,  কোনো মানে নেই । অন্তত আমার কাছে । তবু যাঁরা ভালোবেসে করছেন তাঁদেরকে খারাপ ই বা কেন বলব। গুন্ডাগর্দি বা চৌর্যবৃত্তি তো করছেন না ।


শুধু নতুন এক দর্শনের ফোকাস রাখতেই এই জিরো বাউন্ডারি ম্যাগাজিন । প্রথম সংখ্যা দারুণ সাফল্য পেয়েছে জনপ্রিয়তা এবং অনেক ভালো লেখা থাকার জন্য । একটা পত্রিকায় 100%  মারমার কাট কাট লেখা থাকে না , কিছু compromise করতে হয় । তবে গন্ডা গন্ডা মাফিয়া-কবিতার থেকে,  সুস্থ কবিতা ঢের বেশি মঙ্গল - তা সমাজের পক্ষে এবং পাঠকের পক্ষেও। নতুন কিছু ধারণার জন্ম হলে স্বাভাবিক ভাবেই তার পক্ষে ও বিপক্ষে জনমত তৈরি হয়ে যায় কালের নিয়মে । তৈরি হয় ঈর্ষা,  তৈরি হয় শত্রু । জিরো বাউন্ডারির ক্ষেত্রে ও তাই হচ্ছে । আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুরা আজ সরে গেছে,   গজিয়ে উঠেছে নতুন বৈরীমুখ , কারো মুখোশে,  কারো মুখে । আগের যে সমস্ত মতবাদ ললাটে ইজম ছিল বা আছে  জিরো বাউন্ডারি তাদের বিরোধীতা না করা সত্বেও ।  


জিরো বাউন্ডারি হল প্রতিনিয়ত বাউন্ডারি ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়া যা শেষ হয় না কখনও। এই হল দর্শন। জিরো বাউন্ডারি স্পষ্টতই শূন্যবাদ নয় বা পুনরায় পিছন দিকে ফেরা নয় - তা সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া বর্তমানকে ধরে । কাজেই শত্রুরা লাফাবে ওদের মুখে ছাই ও  পড়বে । জিরো বাউন্ডারি ধার করা নয় , টোকা নয় অথবা জ্ঞানের আস্ফালন নয় । আমরা আমাদের মতো চলবে , তাতে যদি কারো কারো বাউন্ডারি ভাঙে আমাদের কিছু করার নেই ।
কবিতা নিয়ে অনেক কেউকেটাকে দেখলাম বড়ো বড়ো কথা বলতে  ,  কিন্তু যখন তাদের লেখা দেখি বেলুন চুপসে যায় । অর্থাত্ পাণ্ডিত্যের আস্ফালন কবিতায় রূপ পায় না । তা না হোক  অসুবিধে তো নেই । আমরা ও গা করি না । তবে চুনোপুঁটিরা চিরকাল ই একটু বেশি লাফায় । 


জিরো বাউন্ডারি এমন কবিতা project করে না যা সারা শরীরের রক্ত মুখে টেনে জড়ো করে দেখানোর মতো এক ধরনের অসুস্থতা এবং বিকারগ্রস্ততা। জিরো বাউন্ডারি বিশ্বাস করে এবং বলে কবিতা বিশ্বময় এবং বহুধর্মী ও বহুদর্শী । কবিতার নানান রূপ হয়  -   সহজতার মধ্যেও থাকে আবার ভিন্ন রসায়নযুক্ত রহস্যময়তার মধ্যে ও থাকে । কাজেই আমাদের পত্রিকাতে মুখমণ্ডলে রক্ত দেখানোর মতো অসুস্থ কবিতা থাকে না,   সমগ্র শরীরের সুস্থতার মতো বিভিন্ন রকমের কবিতা থাকে । কবিতার খারাপ হয় না । কবিতার হয়ে ওঠা হয় । 

এখন কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে যে জিরো বাউন্ডারি নতুন কী দিল কবিতায় । এ তো যেমন চলছিল তেমনই । আসলে জিরো বাউন্ডারি একটা দর্শন দিয়েছে যা কবিতা বা শিল্পের অভ্যন্তরে চলতে থাকে প্রক্রিয়া । জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টকে কাজে লাগালে কবিতার নতুন নতুন অঞ্চল তৈরি হবে  , তৈরি হবে নতুন ফর্ম । সেই সব চিন্তার সম্ভাব্য সকল রূপরেখা কনসেপ্টের মধ্যে বলা আছে । কবিতার উপরে লিখিত সংবিধানের মতো যার মধ্যে আছে কবিতার অবস্থান পরিবর্তনের কথা । অবস্থান পরিবর্তনের কথা সকলেই বলেন  ,  কিন্তু কোনও মতবাদ তার  application এ অবস্থান পরিবর্তন করার নামে অন্য ভাবে গন্ডিবদ্ধ ছিল  , ফলে কবিতা উন্নততর করতে গিয়ে হয়ে উঠছিল কোণঠাসা । জিরো বাউন্ডারি সেই অবস্থানের মুক্তি ঘটিয়ে মুক্ত দশা এনেছে । ফলে কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া থাকছে কবিদের উপর। 


কবিদের কবিতা থেকেই ইজম তৈরি হয় ; কিন্তু কবিতা থেকে ইজম তৈরি হওয়ার পর তা কিন্তু প্রভাব ফেলতে থাকে অলক্ষ্যে । আর জিরো বাউন্ডারি গোষ্ঠীতন্ত্র বা দাদাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কারণ প্রত্যেক কবি স্বাধীন এবং মুক্ত । কবিকে দাদাতন্ত্রের মধ্যে থেকে অহেতুক তৈলমর্দনের স্নেহ ঝরানোর প্রয়োজন নেই  ,  তাই জিরো বাউন্ডারিতে লিখলে অন্য কোথাও লেখা যাবে না এমন দমবন্ধ অবস্থা নেই । কবিরা কোথায় কোন পত্রিকায় লিখবেন তা তাদের ব্যাপার । প্রত্যেকেই তাদের পক্ষে অভিমত বা জনমত তৈরি করবে এতে অস্বাভাবিকত্বের কিছু নেই । সাহিত্য খোলা একটি মাঠ যেখানে সকলেই নিজের মতো খেলতে চায় এবং সব কবিই চান তাঁর কবিতা শিখরে পৌঁছাক। কারো মধ্যে সুপ্ত , কারো মধ্যে প্রকাশ্য । তবে কবিদের প্রধান এবং প্রথম কাজ হল লেখা;  লেখার মধ্যে থাকলে গলাবাজি কমে যায়  ,  আসে গভীরতা এবং নিস্তব্ধতার শান্ত মনোনিবেশ । কবির লেখা ই হল কবির টিকে থাকার স্তম্ভ  , ইমারত। আর যে কবির মধ্যে দর্শন জ্ঞান অর্জন হতে থাকে,  সেই কবি ক্রমশ নামের পিছনে দৌড়ানোর প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসবেই এবং এটাই সত্য । 


নিজের অস্তিত্বের জন্য সকলকে অস্বীকার করা বা চুলকে দেওয়া -  কবিদের এ এক রিং রোগ অর্থাত্ ছত্রাক ঘটিত এক ধরনের রোগ,  অবশ্যই চিকিত্সকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন আছে । 


জিরো বাউন্ডারির সাথে কারো কোনো বিরুদ্ধতা নেই কারণ এটি একটি ভিন্ন দর্শঁন এবং যা অনেক মতবাদকে ই ব্যাখ্যা করা যাবে । আদর্শগতভাবে জিরো বাউন্ডারি তার স্বতন্ত্রতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং ঝড় ঝঞ্ঝা তো সামলাতে সক্ষম হচ্ছে । কারা ভালো কবিতা লিখছেন , কারা মন্দ কবিতা লিখছেন  এ সব চর্চা করা আমাদের কাজ নয়। বরং আমরা কী বলছি বা কী দিচ্ছি সেটাই আমাদের লক্ষ্য । অযথা বিভ্রান্ত হবার কারণ নেই । জিরো বাউন্ডারি তার ফোকাস ঠিক রেখে এগিয়ে যাবে । 


ইতিমধ্যেই আমরা পাঠকসমাজে slice poetry  উপহার দিয়েছি  ;  বলেছি sandwich poetry কথা বা hybridity in poetry র কথা  । অবশ্য জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টে এগুলো সব বলা আছে খুব পরিষ্কার ভাবে ।

দ্বিতীয় সংখ্যার পর থেকে জিরো বাউন্ডারির শত্রুর সংখ্যা বাড়বে এই আশা নিয়ে সকলের সুস্থতা কামনা করছি । কবিতা ,  কবির জন্য তাঁর নিজস্ব নিরাময়ের পথ্য হয়ে উঠুক।



*ছবিঋণ- ইন্টারনেট





রুমা ঢ্যাং অধিকারী



কবিতা যদি একটা সৃজনশীল শিল্প হয় তাহলে কি তা শুধু স্বেচ্ছাচারীতাকেই মান্যতা দেবে! সামঞ্জস্যের সাথে নান্দনিকতার কি কোন সম্পর্ক নেই!  বর্তমানযুগে দাঁড়িয়ে ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। খুব কম সময়ে অনেক দূরবর্তী মানুষের কাছেও পোঁছে যাচ্ছে। 
বিভিন্ন সোর্স থেকে আজকাল খুব শোনা যায় যে কবিতা তো কবি তার নিজের জন্য লেখে -- কারোর ভালো না লাগলে সে এড়িয়ে যেতেই তো পারে। অবশ্যই কবি তার নিজের ভাবনা নিজের মুক্তির জন্য লেখেন।  আর কারোর ভালো না লাগলে সে এড়িয়ে যেতেও পারে।  কিন্তু এত কবি যে তাহলে বই প্রকাশ করছেন বা করতে চাইছেন তারা কাদের জন্য প্রকাশ করতে চাইছেন!  নিজের বইয়ের তাকে সেই ২০০ টা বই রেখে দেবার জন্য কি? অবশ্যই নয় তো। তাহলে সেই ঘুরেফিরে পাঠকের কাছেই দাঁড়াতে হয়।আর সেই পাঠক যদি শুধুমাত্র কবি হন আর যারা এড়িয়ে যান নি তারা শুধু থাকেন তাহলে কবিতার পরিসর ছোট হয়ে যাচ্ছে তাই নয় কি! 
কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া হোক, পরীক্ষানিরীক্ষা হোক কিন্তু কোথাও তো একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে নান্দনিকতার সঙ্গে। 
শরীরকে বাদ দিয়ে জীবন, অনুভব কিছুই হয় না কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তো আমরা এসব জেনেও খুল্লামখুল্লা ঘোরাঘুরি তো আর করিনা। একটা শালীনতাবোধ কাজ করে। কিন্তু এমন কিছু কবিতা আজকাল সোসাল নেটওয়ার্কে ঘুরছে যেখানে রাখঢাক বলে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। বাস্তবিকপক্ষে সেসব এড়িয়ে যেতে হয় কিছু সংখ্যক মানুষকে। তার মানে সেসব কবিতার পাঠকসমাজের কাছে একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরি করে। কবি যদি এতই নিজের জন্য লেখেন তাহলে তো সেসব ডায়েরিতে লিখে রাখলেই হয় প্রকাশ করতে যাওয়া কেন!  জীবনের স্বার্থে সেরকম কিছু ভাবনা হয়ত আসতেই পারে যা প্রকাশ্য হওয়ার দরকার কবিতার মধ্যে কিন্তু তাকেও পোশাক পড়ানো যায় এবং সুন্দর একটি উপস্থাপনাও করেও যে স্বাদ পাওয়া যায় যে ভাবনার খোরাক পান পাঠক তা তার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারেন আর ঠিক সেখানেই তো সার্থকতা। একবার ভেবে দেখবেন।
এটা ঠিক যে মানুষের মধ্যে সবসময় এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা কাজ করে। সময়কে যদি চাকা দিয়ে বোঝাই তাহলে মানুষ তার আরোহী। চাকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আমাদের চিন্তা ভাবনা কিন্তু এককাটি এগিয়ে থাকতে চায় অর্থাৎ নিজেকে সময়ের থেকে এগিয়ে আপডেট রাখার ঝোঁক। আর সেটাই তো মুক্ত পবন যেখানে বেরিয়ার নেই কিন্তু নান্দনিকতার অভাবও নেই। কবিতা চিন্তা ভাবনা কল্পনা প্রসূত যা একটা মন থেকে বেরিয়ে আরও অনেক মনের সাথে রিলেশন গড়ে তবেই কবিতা হয়ে ওঠে সার্বজনীন।  জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টও পরিষ্কার করে বলেছে পাঠকের স্পেস থাকার কথা। একথাও জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট বলেছে যে কবিতার মধ্যে হৃদয় ব্যাপার যেটা হারিয়ে যেতে বসেছে তাকে প্রতিষ্ঠা করার কথা। তাহলে আসুন মুক্ত চিন্তাকে যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী কবিতা লিখি। 
'জিরো বাউন্ডারি কবিতা'-র প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হবার পর খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এতে আমাদের উৎসাহ আরও দুগুন হয়েছে যেটা আমি কাজে লাগাতে চেয়েছি দ্বিতীয় সংখ্যায়। দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য প্রচুর কবিতা জমা পড়েছিল তার মধ্যে থেকে বেছে আমরা ৬৩ টা কবিতা প্রকাশ করেছি।  জিরো বাউন্ডারি কবিতা লেখা চাওয়ার জন্য আজ পর্যন্ত কখনও অন্য কোন গ্রুপের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নি। এটাই জিবাকের সাফল্য যে এত মানুষ জিবাকের সাথে আছেন। আমি আশা রাখি যাদের লেখা মনোনীত হয় নি তাদের কবিতাও একদিন প্রকাশ হবে এই প্ল্যাটফর্মে।  আপনারা জিবাকে কনসেপ্ট পড়ুন ও পড়ান এবং আমাদের পত্রিকায় কিরকম লেখা প্রকাশ হয় দেখে আমাদের কাছে কবিতা জমা করুন। 
বর্তমানসময়ে আমরা বেশ কিছু শক্তিশালী কবিকে হারালাম যেমন হারালাম ডাক্তার গদাধর দাসকে যিনি জিবাকের প্রবল সমর্থক ছিলেন। আমরা শোকাহত।  তবুও তো কাজ করে যেতে হয়। এবারের সংখ্যায় বিশেষ বিভাগে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর নিজের কবিতা কিছু রাখা হল। আগামী সংখ্যাও তাঁকে স্মরণ করে তাঁর নামে হবে এবং বিশেষ ক্রোড়পত্র বিভাগ থাকবে। 
জিবাকের লেখক ও পাঠকবৃন্দ সকলেই অভিনন্দন ও অনেক শুভেচ্ছা। শীতের নরম রোদের সাথে ধুলো মেখে ওড়ার দিন এসে গেছে।  তাই সকলে সুস্থ থাকুন,  ভালো থাকুন এবং অপরকেও ভাল রাখুন, ভালো মানুষের পরিচয়ে পৃথিবীতে একঝাঁক কবির ডানা উড়ুক।